পুরনো আইফোন, ল্যাপটপ বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস ফেলে দেওয়ার আগে আরেকবার ভেবে দেখুন এর ভেতরে লুকিয়ে থাকতে পারে দামি সোনা! অনেকেই জানেন না, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশে খুব অল্প পরিমাণে হলেও সোনা ব্যবহৃত হয়। মূলত কনডাক্টিভিটি এবং জং না ধরার গুণ থাকার কারণে।
তবে এতদিন এই সোনা উত্তোলন ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, এতে পারদ বা সায়ানাইড ব্যবহার হতো। এবার সুইস গবেষকরা দাবি করেছেন, তারা এমন এক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন, যার মাধ্যমে ই-ওয়েস্ট থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে সোনা উত্তোলন সম্ভব। এই গবেষণা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে Nature Sustainability জার্নালে। গবেষকরা বলছেন, তাদের এই পদ্ধতি শুধু পুরনো ডিভাইস থেকেই নয়, এমনকি ছোট আকারের খনি থেকেও নিরাপদে সোনা উত্তোলনে ব্যবহার করা যাবে।
এতে করে বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার এড়িয়ে, সোনা আহরণ হবে আরও টেকসই, নিরাপদ ও পরিবেশ-বান্ধব। ফলে ভবিষ্যতে ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিংয়ের চেহারা বদলে যেতে পারে পুরোপুরি। তাই আপনার হাতের পুরনো আইফোনে হয়তো এখন সত্যিই লুকিয়ে আছে “সোনার খনি”!বিপজ্জনক ই-ওয়েস্ট, লুকিয়ে থাকা সোনার সম্ভাবনা
বিশ্বজুড়ে দ্রুত বাড়ছে ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-ওয়েস্ট। ২০২২ সালে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ মিলিয়ন টন, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৮২% বেশি। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা পৌঁছাতে পারে ৮২ মিলিয়ন টনে। এই বিপুল বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে পুরনো মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, সার্কিট বোর্ডসহ বহু যন্ত্রাংশ—যেগুলোর ভেতরে সোনা, রূপা, কপারসহ মূল্যবান ধাতু মজুত থাকে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এদের খুব অল্প অংশই যথাযথভাবে রিসাইকেল হয়।
গবেষকদের মতে, যদি এই মূল্যবান উপাদানগুলো নিরাপদ ও কার্যকরভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, তাহলে তিনটি বড় সুবিধা পাওয়া যাবে:ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক ব্যবহার না করে নিরাপদ পদ্ধতিতে রিসাইক্লিং, বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু আহরণ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া। খনি থেকে নতুন করে ধাতু আহরণের প্রয়োজন কমে যাবে।
পারদ-সায়ানাইড নয়, সোনা উত্তোলনে এবার নিরাপদ ক্লোরিনজাত উপাদান
সোনা উত্তোলনে বহুদিন ধরেই ব্যবহার হয়ে আসছে সায়ানাইড ও পারদ যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। ছোট খনিতে ব্যবহৃত পারদ বাষ্প হয়ে বাতাস ও পানিতে মিশে দূষণ ঘটায়। ফলে পারদ দূষণের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে এই খনি কার্যক্রম। এই সমস্যার সমাধানে সুইস গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন এক নতুন নিরাপদ পদ্ধতি। তারা ব্যবহার করছেন ট্রাইক্লোরোআইসোসায়ানিউরিক অ্যাসিড (TCCA)—একটি ক্লোরিনজাত যৌগ, যা সাধারণত সুইমিং পুল ও পানি বিশুদ্ধকরণে ব্যবহৃত হয়।
পদ্ধতিটি কীভাবে কাজ করে: TCCA লবণজলে সোনাকে দ্রবণীয় করে তোলে, এরপর একটি বিশেষ সালফার-সমৃদ্ধ পলিমার ব্যবহার করে দ্রবণ থেকে সোনা আলাদা করা হয়। এই পলিমার তৈরি হয়েছে পেট্রোলিয়াম শিল্পের বর্জ্য সালফার থেকে, যা পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। এই কৌশল সোনা উত্তোলনের প্রক্রিয়াকে নিরাপদ, টেকসই ও কার্যকর করে তুলতে পারে। পাশাপাশি এটি ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিংয়ের ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি
এই সোনা উত্তোলন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় দিক হলো, এটি পুরোপুরি পুনর্ব্যবহারযোগ্য। গবেষকরা এমন প্রযুক্তি তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে ব্যবহৃত রাসায়নিক ও পলিমার বারবার পুনঃপ্রস্তুত করা যায়। এমনকি পলিমার যখন সোনা সংগ্রহ করে নেয়, তখন আলো ব্যবহার করে তাকে আবার তার মূল উপাদানে ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়। এতে করে একই উপাদান দিয়ে বহুবার সোনা উত্তোলন করা যাবে।
ছোট খনি ও প্রান্তিক অঞ্চলে নিরাপদ সোনা উত্তোলনের লক্ষ্য
সোনা উত্তোলনের নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি শুধু বড় শিল্পেই নয়, বরং ছোট খনি ও রিমোট অঞ্চলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন গবেষকরা। কারণ এসব খনিতে সাধারণত স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষ কাজ করেন, যাদের জীবিকা সরাসরি এর সঙ্গে জড়িত। তাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতি না করেই পারদের বিকল্প প্রযুক্তি প্রয়োগ করাই গবেষকদের মূল উদ্দেশ্য।
এই প্রযুক্তি চালুর আগে রয়েছে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ: বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন নিশ্চিত করা, খরচ কমানো ও সহজলভ্যতা বাড়ানো, বাজারে অন্যান্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা অর্জন। গবেষকরা চান বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও উদ্যোক্তা মিলে এগিয়ে এলে প্রযুক্তিটি দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। এতে করে প্রান্তিক খনি শ্রমিকদের আয় রক্ষা করেও পরিবেশবান্ধব খনি কার্যক্রম চালানো যাবে।
গবেষকরা আশা করছেন, এই পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন শুধু সোনা উত্তোলনকেই নিরাপদ করবে না, বরং পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি বৈশ্বিক ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকেও আরও কার্যকর করে তুলবে। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে চাইলে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ বাংলাদেশেও হতে পারে। যেখানে ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিং বা অপ্রাতিষ্ঠানিক খনি কার্যক্রমের সম্ভাবনা রয়েছে।নতুন প্রযুক্তি যদি আরও ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে ‘বর্জ্য’ আর বর্জ্য থাকবে না, বরং হয়ে উঠবে সোনার খনি!